• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি পারবে না, আমরা বিজয়ী হয়েছি: প্রধানমন্ত্রী

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৬ জুন ২০২২  

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা পদ্মা সেতু নির্মাণে বাধা দিয়েছিল, সেতু নির্মাণের মাধ্যমে তাদের একটা উপযুক্ত জবাব দিতে পারলাম, বাংলাদেশও পারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’। কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবে না; আমরা বিজয়ী হয়েছি। 

গতকাল দুপুরে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী বাংলাবাজার ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফেরিঘাটে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় সভাপতির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।

শত ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও বাধা মোকাবিলা করে জনগণের শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণার কারণেই তাঁর পক্ষে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ দেশের জনগণ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই সম্ভব হয়েছে। সারা দেশের মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতু প্রমাণ করে জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। আমি সেটাই বিশ্বাস করি।

আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাবা-মা, ভাই সব হারিয়ে পেয়েছি আপনাদের। আপনাদের পাশে আমি আছি, আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, আপনাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমি যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে সব সময় প্রস্তুত। আমি আপনাদের প্রয়োজনে আমার নিজের জীবনটাও দেব। প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ২০০১ সালে আমরা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। খালেদা জিয়া এসে তা বন্ধ করে দেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে। তখন খালেদা জিয়ারা বলেছিলেন আওয়ামী লীগ কোনো দিন নাকি পদ্মা সেতুর কাজ করতে পারবে না। আমি তাঁকে (খালেদা জিয়া) বলব আসুন, দেখনু পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কি না। ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফেরিঘাট প্রান্তে বেলা সাড়ে ১১টায় জনসভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ফজরের নামাজের পর থেকেই মানুষ খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জনসভাস্থলে আসতে থাকে। সড়ক ও নৌ পথের বাস, লঞ্চ-ফেরির মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা থেকে আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনসভায় যোগদান করেন। বাদ্যযন্ত্র, ব্যান্ডপার্টি, পদ্মা সেতুর প্রতিকৃতিসংবলিত ব্যানার এবং অসংখ্য স্লোগান বুকে গেঁথে মানুষের স্রোত জনসভাস্থলের দিকে ছিল।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভার পদ্মা সেতুর আদলে সাজানো মূল মঞ্চের পিলার ছিল ১১টি। মঞ্চের সামনে খরস্রোতা পদ্মায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা চলাচল করতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা বহনকারী সুসজ্জিত নৌকা আসা-যাওয়া করার দৃশ্য ছিল মনোরম। মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতুতে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টোল দিয়ে সেতুর মাঝামাঝি অংশে গাড়ি থামিয়ে নেমে সেতুর দৃশ্য দেখেন তিনি। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে লাল-সবুজের মাস্ক পরিহিত প্রধানমন্ত্রীকে বেশ প্রাণবন্ত দেখা যায়। এরপর দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে জাজিরা প্রান্তে ফলক উন্মোচন করেন। এ সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, শেখ হেলাল এমপি, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন উপস্থিত ছিলেন। দুপুর ১২টা ৫১ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী জনসভাস্থলে এসে পৌঁছে হাত নেড়ে জনসমুদ্রে থাকা লাখ লাখ মানুষকে শুভেচ্ছার জবাব দেন। এ সময় লাখ লাখ নেতা-কর্মী করতালি ও স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানান। বক্তব্য শেষে আবেগে উদ্বেলিত প্রধানমন্ত্রী নিজেই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান ধরলে জনসমুদ্রে থাকা মানুষের গগনবিদারী স্লোগানে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঞ্চে আসার পর বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযাগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন এমপি। সভা যৌথভাবে পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ও প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে জাজিরা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। এর আগে বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, শেখ হেলাল এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি খোকা সিকদার, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাহাবুদ্দিন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে, শিবচর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহজাহান মোল্লা প্রমুখ। জনসভায় ১৪ মিনিট ভাষণ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সভামঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আলহামদুলিল্লাহ আমরা সেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। আর আপনাদের কষ্ট করতে হবে না। এই খরস্রোতা পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে আর কাউকে সন্তান হারাতে হবে না, বাবা-মাকে, ভাইবোনকে হারাতে হবে না। আজকে সেখানে আপনারা নির্বিঘ্নে চলতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি।

দুর্নীতি নয়, বরং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তদবিরেই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গিয়েছিল মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। দুর্নীতির সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, কে দুর্নীতি করেছে? এ সেতু আমাদের প্রাণের সেতু। যে সেতুর সঙ্গে আমার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য জড়িত, সেই সেতু করতে যেয়ে কেন দুর্নীতি হবে?

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, যখন ওই ড. ইউনূস তাঁর ওই গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থেকে চলে যেতে হলো। ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে তদবির করে আমেরিকায় তদবির করে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দিল। বলল দুর্নীতি হয়েছে। তারা (বিশ্বব্যাংক) টাকা দেয়নি। আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম টাকা বন্ধ করেছ ঠিক আছে। বাংলাদেশ বসে থাকবে না। আমরা নিজের টাকায় এই পদ্মা সেতু তৈরি করব। অনেক কথা বলেছে যে, এই সেতু নাকি আমরা করতেই পারব না। বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয় বলে যারা নিরুৎসাহ করেছিলেন তাদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, আজকে কীভাবে করতে পারলাম? বাস্তবে আপনারা এই দেশের জনগণ আমাকে সমর্থন দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। জনগণের শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। আমি সেটাই বিশ্বাস করি।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক গতি আসার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি। আজকে পদ্মা সেতু হয়েছে। এখানেও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, শিল্পাঞ্চল হবে, কর্মসংস্থান হবে, কলকারখানা হবে, আমাদের ফসল উৎপাদন হবে। সেই ফসল আমরা প্রক্রিয়াজাত করতে পারব। দেশে-বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। এখানে যে মাছ হবে তা আমরা প্রক্রিয়াজাত করে দেশে-বিদেশে পাঠাতে পারব। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে যাবে। ভাগ্য পরিবর্তন হবে। খাদ্যের চাহিদা পূরণে সবাইকে ফসল উৎপাদনের দিকে জোর দিতে এবং আগামী বর্ষাকালে এ অঞ্চলে বন্যা হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, এখন থেকে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, আপনারাও প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার শক্তি বাংলাদেশ রাখে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য আজকের দিনটি ‘বিশেষ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই শরীয়তপুরে যখন এসেছি, তখন কী ছিল? লঞ্চে করে এসেছি, লঞ্চ নষ্ট হয়ে গেছে। নৌকায় করে একেকটা এলাকায় গিয়েছি, মিটিং করেছি। আজকে সেই শরীয়তপুরের অবস্থা পাল্টে গেছে। কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজের উন্নয়ন হয়েছে। মাদারীপুরেও একই অবস্থা ছিল। গোপালগঞ্জ যেতে ২২ ঘণ্টা লাগত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মাথা নোয়াইনি, আমরা কোনো দিন মাথা নোয়াব না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও কখনো মাথা নোয়াননি, তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখান নাই, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজকে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, এই বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার বাবা জীবন দিয়ে গেছেন। জীবন দিয়ে গেছেন আমার মা-ভাইয়েরা। আমি ও আমার ছোট বোন বেঁচে আছি। এই পদ্মা সেতু করতে গিয়ে আমাদের অনেক অসম্মান করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আবুল হোসেন, সচিব মোশাররফ, উপদেষ্টা মসিউর রহমান- মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাঁদের অপমান করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার ছেলেমেয়ে জয়-পুতুল, রেহানার ছেলে ববিসহ কত মানসিক যন্ত্রণা তারা দিয়েছে। কিন্তু আমরা পিছু হটি নাই। আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল- আমরা এই সেতু নির্মাণ করব। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন আমরা করব। আমরা সেটা করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অনেক জ্ঞানীগুণী লোক ছিলেন, অর্থনীতিবিদ, বড় বড় আমলা ছিলেন- সবাই বলেছেন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু সম্ভব নয়। আজকে নিজেদের টাকায় কীভাবে করতে পারলাম? আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, আমি আগেই বলেছি আমার একমাত্র শক্তি আপনারাই। আমার একমাত্র শক্তি বাংলার জনগণ। বাবা-মা-ভাই সব হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলাম এই বাংলাদেশে। সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। নৌকায় করে করে এক একটা এলাকায় গিয়েছি। কাদাপানিতে নেমেছি। মিটিং করেছি। আমরা রাস্তাঘাট-ব্রিজ করেছি।

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –