• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২২  

তোফায়েল আহমেদ   

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। মনে পড়ে, ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সাবেক বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল ওসমানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি আ ক্রুশিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টোয়েন্টি ফিফথ। ’ তখন ওসমানী সাহেব পুনরায় প্রশ্ন রাখেন, ‘কাল তো ২৩ মার্চ। পাকিস্তান দিবস।

সে উপলক্ষে ওরা কি কিছু করতে চাইবে না?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু করতে পারে। তার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় না। ’ কী নিখুঁত হিসাব বঙ্গবন্ধুর। হিসাব করেই তিনি বলেছিলেন ২৫ মার্চেই পাকিস্তানিরা ক্র্যাকডাউন করবে।

আমার স্মৃতির পাতায় সেই ২৫ মার্চের কথা মনে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে শিল্পপতি শ্রদ্ধেয় জহিরুল ইসলামের কাছ থেকে আমরা একটা গাড়ি চেয়ে নিয়েছিলাম। এই গাড়ির পেছনে আমাদের ব্যাগ থাকত। আমরা তৈরি থাকতাম, কোন সময় কী ঘটে। বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন, ‘প্রস্তুত থেকো। ’ যুদ্ধ শুরু হলে কলকাতা গেলে আমরা কোথায় থাকব? ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ বঙ্গবন্ধু আমাদের ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছেন। সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দান পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। ২৫ মার্চ বহু লোক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসেছেন। অনেকেই অনুরোধ করে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু, ৩২ নম্বরের বাসভবন ত্যাগ করেন। ’ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ওরা যদি আমাকে না পায়, ঢাকা শহরকে ওরা তছনছ করবে। লক্ষ লক্ষ লোককে ওরা হত্যা করবে। আমি তো সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমি এভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারি না। আমি আমার বাড়িতেই থাকব। কারণ আমি আমার জীবন বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। জীবন এবং মৃত্যু একসাথে। আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য মৃত্যুকে বারবার আলিঙ্গন করেছি। এবারও আমি এখানেই থাকব। আমার দেশ যে স্বাধীন হবে এতে কোনো সন্দেহ নাই। ’

২৫ মার্চ রাতে ঢাকা নগরীর নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর পাকিস্তান বাহিনী ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামানের গোলা, মর্টারের শেল আর মেশিনগানের ভয়াল গর্জনে রাত ১২টার পর পুরো নগরীই জাহান্নামে পরিণত হয়। চারদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শুরু করে ইতিহাসের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। শুরু হয় বাঙালি নিধনে গণহত্যা। চারদিকে শুধু বিকট আওয়াজ। লক্ষাধিক লোককে এক রাতেই হত্যা করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

মার্চের ২৫ থেকে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত কালপর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে ৯ মাসব্যাপী বর্বর গণহত্যা পরিচালনা করে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নীলনকশায় ঢাকার চারটি স্থান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং তৎকালীন পিলখানা ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দসহ ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগ নেতা চিশতী হেলালুর রহমান, জাফর আহমদসহ জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকে হত্যা করে। এ ছাড়া রাজশাহী, যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর আওতাভুক্ত। একাত্তরের গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ যে শহীদ হয়েছে তার অকাট্য প্রমাণ বহন করছে ওই সময়ে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলো। অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা হেরাল্ড ট্রিবিউনের রিপোর্ট অনুসারে ২৫ মার্চ রাতে শুধু ঢাকা শহরেই এক লাখ লোককে হত্যা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালানোর অভিযোগ করেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের মতে, ’৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘তিন মিলিয়ন’ বা ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাজি বাহিনীর বর্বরতার চেয়েও ভয়াবহ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হেরাল্ড ট্রিবিউন ১৯৭১ সালের ১ জুন লিখেছে, ‘পাকিস্তানের গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে লাখ লাখ উদ্বাস্তু মুসলমান এবং অন্যরা স্রোতের মতো ভারতে চলে আসছে। ’ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক মাস পর ২৬ এপ্রিল নিউজউইক লিখেছে, ‘ইসলামাবাদ হাইকমান্ডের নির্দেশে সেনারা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক এবং নেতৃত্ব প্রদানে সম্ভাবনাময় এমন সব লোককে পাইকারি হারে হত্যা করছে। ’ মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশে গণহত্যা তদন্তে পাকিস্তানে যে ‘হামুদুর রহমান কমিশন’ গঠিত হয়েছিল, সেই কমিশন তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশে গণহত্যার কথা স্বীকার করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কথা বলেছে।

২০১৮-র ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে বিষয়টি উত্থাপন করি এবং ওই বই থেকে উদ্ধৃত করে বক্তৃতায় বলি, ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হোক। সেদিন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রস্তাবটি সমর্থন করেন এবং একটি দিন নির্ধারণ করে আলোচনার প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। ১১ মার্চ শনিবার সর্বসম্মতক্রমে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত মহান জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

[email protected]

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –