• বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

জনসমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না- বঙ্গবন্ধু

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৮ নভেম্বর ২০২০  

১৯৫২ সালে জেল হতে বের হলাম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর। জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, 'যদি সুযােগ পাও একবার চীন দেশে যেও'। অল্পদিনের মধ্যে তারা কত উন্নতি করেছে। চীন দেশের খবর আমাদের দেশে বেশি আসে না এবং আসতে দেওয়াও হয় না। তবুও যতটুকু পেতাম তাতেই মনে হতাে যদি দেখতে পেতাম কেমন করে তারা দেশকে গড়েছে! হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসে আমন্ত্রণ এলাে পিকিং-এ শান্তি সম্মেলনে যােগদান করতে হবে। পাকিস্তান শান্তি কমিটি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। পূর্ব বাংলা থেকেও কয়েকজনকে যেতে হবে। ৩৭টি দেশ এতে যােগদান করবে। অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যােগদান করবেন কেন? আপনারা তাে কমুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে আমরা কমুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যােগদান করতে রাজি। রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই। কারণ যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; বিশেষ করে আমার দেশে —যে দেশকে পরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কাঁচামাল চালান দিতে হয়। যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সামান্য দরকারি জিনিস জোগাড় করতে যাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে দেশে যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন। কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লক্ষ লােক শৃগাল কুকুরের মতাে খেয়ে মরেছে। তবুও আপনারা বলবেন, আজ তাে স্বাধীন হয়েছি। কথা সত্য, পাকিস্তান নামটা পেয়েছি; আর কতটুকু স্বাধীন হয়েছি আপনারা নিজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। যাহা হউক, পাকিস্তান গরিব দেশ, যুদ্ধ চাইতে পারে না। যুদ্ধ হলে পাকিস্তানের জনগণের সকলের চেয়ে বেশি কষ্ট হবে এই জন্য। তাদের পাট, চা, তুলা অন্যান্য জিনিস বিদেশে বিক্রি না করলে দেশের জনগণের কষ্টের সীমা থাকবে না। দুর্ভিক্ষ মহামারি সমস্ত দেশকে গ্রাস করবে। তাই মানুষের মঙ্গলের জন্য, পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য -যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। ঠিক করলাম শান্তি সম্মেলনে যােগদান করতে হবে। আমাদের পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন, যাকে আমরা সকলে ‘মানিক ভাই’ বলি, বন্ধুবর খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস আর ইউসুফ হাসান এবং আমি, এই পাঁচজন যাবাে ঠিক হলাে। কিন্তু পাসপাের্ট কোথায়? ওটা না হলে তাে আর কোনাে প্লেন আমাদের নেবে না। সকলেই সরকারের কাছে দরখাস্ত করেছে, করি নাই আমি—কারণ কোথাও আবার সভা করতে গিয়ে থাকবাে। আরও ভেবেছিলাম, বােধ হয় পাসপাের্ট পাওয়া যাবে না। যা হােক, যাবার মাত্র একদিন পূর্বে বন্ধুবর ইয়ার মােহাম্মদ খান (তৎকালীন আওয়ামী লীগের ট্রেজারার), যিনি আওয়ামী লীগের ট্রেজারার, আমাকে বললেন, আজই দরখাস্ত করাে । চেষ্টা করে দেখা যাবে। যা হউক, তার ও আতাউর রহমান সাহেবের কথায় দরখাস্ত করলাম। কিন্তু পরে আবার জানতে পারলাম আমার দরখাস্ত পাসপাের্ট অফিসে পৌছে নাই। মহাবিপদ! পাসপাের্ট অফিসার জনাব শুকুর সাহেব খুব ভালাে লােক। ব্যবহারও চমৎকার, আর কাজও করতে পারেন। তার মতাে কর্মচারী হলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য। তিনি বললেন, আবার আমার কাছে আর একটা দরখাস্ত করুন। তাই করলাম। তার হাতে তাে আর ক্ষমতা নাই—‘লাল ফিতার প্যাচ' । করাচির হুকুম প্রয়ােজন। তাহা হলে তাে পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার কোনাে জলসাই হয় না। খবর নিয়ে দেখা গেল তখনও হুকুম পৌছে নাই। হােম ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নাই। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা সকলেই বসে রইলাম পাসপাের্ট অফিসে। পরের দিনই যেতে হবে—কোনাে কিছু ঠিক করতে পারি নাই। কাপড় জামা টাকা পয়সা কোনাে কিছুর জোগাড় নাই। রাত্রে করাচি থেকে মিয়া ইফতেখার উদ্দিনের কাছ থেকে খবর পেলাম সিট রিজার্ভ করা হয়ে গেছে। সকালে আবার পাসপাের্ট অফিসে গেলাম। প্রায় দশটার সময় খবর এলাে হুকুম এসেছে পাসপাের্ট দিয়ে দিতে। কিন্তু ১২টায় বিওএসি প্লেন ছেড়ে যাবে-এর মধ্যে কী করবাে? ভেবে কূল পাই না। সাড়ে এগারােটার সময় পাসপাের্ট পেলাম। ফোন করে জানলাম, প্লেন ২৪ ঘণ্টা লেট। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সময় কিছু পাওয়া গেল। পাসপাের্ট নিয়ে ব্রিটিশ হাই কমিশনারের অফিসে গেলাম। ব্রহ্মদেশের কনসাল অফিসে গেলাম। আমরা সকলেই এক সাথে ঘুরছি। পরে জানা গেল ভিসার প্রয়ােজন নাই, কারণ আমরা তাে এখনও ‘রানিমা’র প্রজা। আমাদের বিদেশে লিখতে হবে পাকিস্তানি ব্রিটিশ নাগরিক। হায়রে স্বাধীনতা! বাড়ি ফিরতে প্রায় ৬টা বেজে গেল। টাকার প্রয়ােজন, আমরা তাে বড়লােক নই। আর পাকিস্তানে ফটকা ব্যবসাও করতে আসি নাই যে নগদ টাকা থাকবে! ধার করতে হবে। জোগাড়ে লেগে গেলাম। ফরেন এক্সচেঞ্জ দরকার। যাহা হােক, কোনােমতে কিছু জোগাড় করলাম, কাপড়-চোপড়ও কিছু জোগাড় হলাে। দুই বৎসর আড়াই বৎসর জেলে থেকে কাপড় প্রায়ই ছােট হয়ে গেছে। পরের দিন সকালে হঠাৎ আতাউর রহমান সাহেব ফোন করলেন প্লেন ৮টায় আসবে, যথাসময় ৯টায় ছাড়বে। আমাকে খুঁজতে আতাউর রহমান সাহেব গেছেন, আর আমি খুঁজতে আসছি তাঁকে। তাঁর বাসায় খবর পেলাম প্লেন ছাড়ার সময়। তাড়াতাড়ি কমলাপুর চললাম মানিক ভাইকে আনতে, কারণ তিনি তাে খবর জানেন না। যেয়ে দেখি মানিক ভাই বসে রয়েছেন, কোনাে প্রস্তুতি নাই। উনি ঠিক করেছেন যাবেন না, কারণ টাকার অভাব; বিশেষ করে ইত্তেফাকের লেখা কে লিখবে, টাকার জোগাড় কে করবে? আপনারা বােধ হয় জানেন না, মানিক ভাই ইত্তেফাকের শুধু সম্পাদক নন, লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে পিয়নও বটে। দুনিয়ার যাবতীয় কাজ তার প্রায় একলারই করতে হয়। অন্য কর্মীরা প্রায়ই জেলে, ওয়াদুদ বাইরে । ওয়াদুদের ওপর সমস্ত ভার দিলেন। আর খােন্দকার আবদুল হামিদের মতাে ২/১ জনকে লেখা দিতে অনুরােধ করে রওয়ানা হলেন। আওয়ামী লীগ অফিসে এসে আতাউর রহমান সাহেবের সাথে দেখা হলাে। আমরা তেজগাঁ অ্যারােড্রামের দিকে রওয়ানা হলাম, যেয়ে দেখি প্লেন প্রস্তুত; পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত। খুবই আনন্দিত হলাম, বিশেষ করে মাহমুদুল হক কাসুরী, আবদুল্লা মল্লিক ও অনেককে দেখে।
.
প্লেন ছেড়ে দিলাে। ভাবলাম নূতন দেশ দেখবাে, কত আনন্দ! শুনে আরও খুশি হলাম রেঙ্গুনে বিকাল ও রাতে থাকতে পারবাে বলে। সারা বিকাল আমরা রেঙ্গুন শহর দেখতে পারবাে। প্রায় ২টায় রেঙ্গুন পৌছলাম। আমাদের বিরাট একটা হােটেলে নিয়ে যাওয়া হলাে। সুন্দর কামরা দেওয়া হলাে। আমরা গােসল করে প্রস্তুত হলাম। আতাউর রহমান সাহেব তাঁর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় টাঙ্গাইলের আরফান খান সাহেবের ছেলে আজমল খা—ওখানে থেকে ব্যবসা করে—অনেক টাকার মানুষ ও পুরানা ব্যবসায়ী, সকলে জানে ও চেনে— তাকে ফোন করে দিলেন। কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি এলেন। তাঁর নিজের মটরগাড়ি আছে। সেই গাড়িতে করে প্রথমেই তার রয়াল স্টেশনারি দোকানে নিয়ে গেলেন। বিরাট দোকান দেখে আনন্দ হলাে। তাঁর কাছ থেকে শুনলাম নিজের চেষ্টায়ই তিনি লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক। তার বয়স ৩০/৩৫ বৎসর হবে। দেশি লােক পেয়ে অনেকদিন পরে সে আমাদের সাথে প্রাণ খুলে আলাপ করলাে। দেশের কথা জানতে চাইলাে। আমাদের নিরপেক্ষভাবে ব্ৰহ্মদেশের খবর দিলাে। তাঁর বাসায় নিয়ে গেল এবং স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাে। ভদ্র মহিলার চমৎকার ব্যবহার, নিজেই আমাদের খাওয়ালেন। তারপর ক্লাব, বৌদ্ধদের প্যাগােডাসহ সব ভালাে ভালাে জায়গা—আমাদের দেখালেন।
.
যতদূর খবর নিয়ে জানলাম, ব্রহ্মদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। বিপ্লবীরা বহুস্থান দখল করে আছে, আর মাঝে মাঝেই রেঙ্গুন শহরের পানি বন্ধ করে দেয়। আর একটা ভয়াবহ খবর পেলাম, ব্যান্ডিট’রা দিনে দুপুরে ডাকাতি করে। ভয়েতে দিনের বেলায়ও কেউ জানাশােনা মানুষ না হলে দরজা খােলে না।আতাউর রহমান সাহেবের আর এক চেনা মানুষ, খুব নামকরা রেঙ্গুনেই থাকেন, তিনি একজন ডাক্তার, তাঁর বাড়িতে আমরা যাই। তিনি বাড়ি ছিলেন না। অনেক ডাকাডাকি করলাম, দরজা খােলে না। দোতালার উপর থেকে ঐ দেশি এক মহিলা কথা বললেন। তাঁকে দরজা খুলতে বলা হলাে, তিনি। অস্বীকার করলেন। আমরা বললাম, একটু কাগজ দেন, একটা চিঠি লিখে রেখে যাই। তিনি বললেন, কাগজ দিতে হলে দরজা খুলতে হবে। তােমাদের চিনি না। পরে চিঠি লিখে তাকে নিতে বললাম, তিনি অস্বীকার করলেন। বললেন, “ওখানে ফেলে যাও, তােমরা চলে গেলে আমি কুড়াইয়া নিব।” আমরা আজমল খাঁ সাহেবের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, এর কারণ কী? তিনি বললেন, “এইভাবে ডাকাত দল বাড়িতে আসে, তারপর হাত পাও বেঁধে সর্বস্ব নিয়ে চলে যায়। এটা দিনের বেলায় প্রায়ই হয়ে থাকে। পথের থেকেও টাকাওয়ালা লােক ধরে নিয়ে যায়। পরে টাকা দিলে ছেড়ে দেয়।” 
.
যা হােক, এরপর প্যাগােডা দেখতে গেলাম। প্যাগােডা বৌদ্ধদের প্রার্থনা করার মন্দির। অনেক অর্থ দিয়ে গড়া বিরাট বিরাট মন্দির, দেখতে খুবই সুন্দর। ও দেশের লােকগুলি খুবই ধর্মভীরু বলে মনে হলাে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এক একটা মন্দির করেছে। রাত্রে আমরা আমাদের রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদের ঢাকার লােক, মিষ্টভাষী সন্দেহ নাই। আমরা যেয়ে দেখি ছবি দেখছেন, সে ছবি আমাদের রাষ্ট্রদূতের অফিস থেকে তােলা হয়েছে। প্রায় সকল ছবিই আমাদের রাষ্ট্রদূতের নিজের ও তার আত্মীয় পরিবার পরিজনের। কোথায় কবে খানা খেয়েছেন, কবে ‘ব্যাঙকোয়েট’ দিয়াছেন, ব্রহ্মদেশের প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রদূত অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেগুলি রঙিন ছবি। কত টাকা খরচ করা হয়েছে, গােপনে খোঁজ নিতে চেষ্টা করলাম। অনেকে অনেক রকম বললাে, মনে হয় যথেষ্ট খরচ হয়েছে। রাষ্ট্রদূত অনেক জাঁকজমকের সাথেই থাকেন, বিরাট অফিস ও বহু কর্মচারী তাঁকে সাহায্য করে। দেখে মনে হলাে, যাদের টাকা দিয়া এত আঁকজমক তাদের অবস্থা চিন্তা করলেই ভালাে হতাে। তাদের ভাতও নাই, কাপড়ও নাই, থাকবার মতাে জায়গাও নাই। তারা কেউ না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘােরে। তাদেরই সামনে ছেলেমেয়েরা না খেয়ে তিলে তিলে মারা যায়। নীরবে শুধু অশ্রু বিসর্জন করে আর খােদার কাছে ফরিয়াদ জানায়। জানি না খােদার কাছে সে ফরিয়াদ পৌছে কি না! ব্রহ্মদেশ সম্বন্ধে যা কিছু শুনলাম ও বুঝতে পারলাম তার কিছুটা প্রকাশ করতে চাই । অনেকেই জানেন ওদেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। যাকে আমরা অনেকেই ‘বিপ্লব’ বলে থাকি। কম্যুনিস্ট ও কারেন সম্প্রদায়ের লােকেরা যুদ্ধ করছে সরকারের বিরুদ্ধে, দেশকে নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য। উ ন্যু সরকারও তাদের সাথে ভীষণ যুদ্ধ চালাচ্ছে; কিন্তু ৫/৬ বৎসরেও বিদ্রোহীদের দমন করতে পারছে না।
.
তার প্রধান কারণ এটা একটি জঙ্গলময় দেশ। বিরাট বিরাট বন, পাহাড়; নদীর সংখ্যাও খুব বেশি। কখনও বিদ্রোহীরা সম্মুখ যুদ্ধে আসে না। গেরিলারা যুদ্ধ চালায়। হঠাৎ আক্রমণ করে গভীর বনে পালাইয়া যায়। কার সাধ্য তাদের খুঁজে পায়।
তবে বিদ্রোহীরা কিছু করতে পারছে না। এর কারণ কী? কারণ জনগণের সমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না। সংগ্রামরত কম্যুনিস্টরা একটি সুবিধা পেয়েছে কারেন সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে। কারেন একটা জাতি। এরা ব্রহ্মদেশ সরকারের কাছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করে, কিন্তু সরকার তা দিতে অস্বীকার করায় তারা ক্যুনিস্টদের সাথে এক হয়ে বিপ্লব শুরু করে। জাপান যখন ব্রহ্মদেশ অধিকার করে তখন এরা বহু অস্ত্র জোগাড় করে। পরে সরকারের সাথে যুদ্ধে এইগুলি কাজে লাগায়। এখন ব্রহ্ম সরকার কারেনদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দিতে রাজি আছে। কারেনদের যদি ব্রহ্ম সরকার হাতে নিতে পারে অথবা তাদের সঙ্গে একটা মিটমাট করতে পারে তাহলে ক্যুনিস্টরা বেশিদিন টিকতে পারবে না, হয় তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে, না হয় দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। 
.
পূর্বেই বলেছি, জনসমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না। কম্যুনিস্টদের জনসমর্থন তত নাই। কারণ, তারা মাঝে মাঝে রেঙ্গুন শহরের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। যাকে তাকে ধরে নিয়ে টাকা আদায় করে, আর যে অঞ্চল তাদের অধিকারে যায় সেই অঞ্চলের জনগণের কাছ থেকে অর্থ ও খাদ্য আদায় করে। বােধ হয় গভীর জঙ্গলে থাকে তারা, তাই জোগাড় করতে পারে না খাদ্য ও অন্যান্য, যা তাদের বিশেষ প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র, এটুকু জানবার সুযােগ হয়েছে আমার। অনেক রাত্রে হােটেলে ফিরে এলাম। সেখানেও অনেকের সাথে আলাপ হলাে। ভােরেই আমাদের প্লেন ছাড়বে । তাই একটু ঘুমাতে চেষ্টা করলাম । খুব ভােরে আমাদের প্লেন ছাড়লাে। প্রায় ৩ ঘণ্টা পরে আমরা ব্যাংককে পৌছলাম। সামান্য এক ঘণ্টা বিশ্রাম করার পর আবার রওয়ানা হলাম। 
.
নহংকংয়ের দিকে। প্রায় ৪ ঘটিকার সময় আমরা হংকং পৌছলাম। যাবার সময় প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে আমাদের উড়ােজাহাজ চললাে, নিচে সমুদ্র। আমরা উড়ে চলেছি, মাঝে মাঝে মেঘ দেখলে মানিক ভাই ঠাট্টা করে বলতেন, “আবার বামপিং আসছে, খেয়েছে বাবা!” আমরা সাবধান হয়ে বসতাম । কারণ প্লেন মেঘের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় নিচের দিকে নেমে পড়ে, তাতে অনেকের দম নিতে কষ্ট হয়। কারণ মেঘের মধ্যে হাওয়া থাকে না। হংকংয়ের কাছে যখন গেলাম তখন মনে হতে লাগলাে, আহা দূর থেকে দেখতে কী সুন্দর দেশ! পাহাড়ের উপর থেকে আস্তে আস্তে একটা দেশ। নিচের সমুদ্র পর্যন্ত নেমে আসছে, মধ্যে মধ্যে নদী। একটা বাড়ি অনেক উপরে, একটা বাড়ি অনেক নিচে। সমুদ্রের পাড়ে জাহাজ ভিড়ে আছে, কোনাে কোনাে জাহাজ আবার ছেড়ে যাচ্ছে। আবার ছােট ছােট লঞ্চগুলি এদিক ওদিক ছােটাছুটি করছে। আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গােছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন। 
.
হংকংয়ের কোলন হােটেলে আমাদের রাখা হলাে। কিছু সময়ের মধ্যে পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পীর সাহেব মানকী শরীফ, খান গােলাম মহম্মদ খান লুন্দখাের, ফজলুল হক সায়েদা, মি. হানিফ এবং পাঞ্জাব থেকে কয়েকজন নেতা পৌছালেন। তাঁদের মধ্যে পাঞ্জাব মুসলিম লীগ দলের মি. আবদুল কাইয়ুমও সদস্য ছিলেন। সেখানে বসে আমাদের নেতা ঠিক করা হলাে। সকলে মিলে পীর মানকী শরীফকে পাকিস্তান ডেলিগেশনের নেতা এবং জনাব আতাউর রহমান খান ও জনাব মাহমুদুল হক কাসুরী ডেপুটি নেতা হলেন। ক্যুনিস্ট দেশে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের দলের মধ্যে অধিকাংশই আমরা ক্যুনিস্ট ভাবাপন্ন না। ভারতবর্ষ থেকেও কম্যুনিস্ট ছাড়া অনেকে বড় বড় কংগ্রেসী, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃবৃন্দ গিয়াছিলেন। আমরা আওয়ামী লীগের লােকসংখ্যায় বেশি হয়ে গেলাম; কম্যুনিস্টরা আমাদের ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে থাকে; আর মুসলিম লীগরা ক্যুনিস্ট ভাবাপন্ন বলে গালমন্দ করে থাকে। আমরা চা খেলাম। কাগজের রিপাের্টার এসে আমাদের ফটো নেওয়া শুরু করলাে। আমরা হােটেলে এসে দেখলাম যার যার মালপত্র তার তার রুমে ঠিক করে রাখা হয়েছে। কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে তাড়াতাড়ি আমরা হংকং শহর দেখতে বের হলাম। কিছু কাপড়চোপড়ও আমাদের কিনতে হবে। আমরা আমাদের পাকিস্তানি টাকা পরিবর্তন করে হংকং ডলার করলাম । হংকংয়ে বহু দোকান দেখলাম সিন্ধু প্রদেশের হিন্দুদের। আমাদের পেয়ে তারা খুব খুশি হলাে। তাদের দোকান থেকেই আমরা মালপত্র কিনলাম। তারা আমাদের কাছে দেশের কথা জানতে চাইলাে। তারা বললাে, “আমরা পাকিস্তানি, দেশে ফিরে যেতে পারবাে কি না? আমাদের আত্মীয়স্বজন সকলেই হিন্দুস্তানে চলে এসেছে। বাড়িঘর বােধ হয় নাই।” অনেক প্রশ্ন করলেন। আমরাও তাদের সান্ত্বনা দিলাম। বললাম, দেশ সকলের, আপনারা ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আপনাদের ঘরবাড়ি ফিরে পাবেন।

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –