• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

তিনি আছেন বলেই ‘সঙ্কটে ম্রিয়মাণ’ হইনি আমরা

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০  

আলী হাবিব 

২০২০ সালটি কেটে গেল ‘ভালো-মন্দ মিলায়ে সকলি’—এমন কথা বলা যাবে না। বরং সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলা যেতে পারে বড় ধরনের মন্দার বছর ২০২০। যদিও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের আয় বেড়েছে। পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। গতি শ্লথ হলেও মেট্রো রেলের মতো মেগাপ্রজেক্টের কাজ কিছুটা এগিয়েছে। রপ্তানিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। কমেছে আমদানি। জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে চিন্তায় ফেলেছে মূল্যস্ফীতি। মন্দা কাটেনি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে। পুঁজিবাজারের হতাশা আগের মতোই রয়ে গেছে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও পড়েছে করোনার প্রকোপ। একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে ইভেন্ট, ম্যাচ, টুর্নামেন্ট। ক্রিকেটে ১০টি টেস্ট খেলার কথা ছিল এবার। খেলতে পেরেছে দুই টেস্ট। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মাত্র তিনটি ওয়ানডে খেলতে পেরেছে বাংলাদেশ। ফুটবলে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মিলিয়ে তিনটি প্রতিযোগিতা পুরোপুরি শেষ হতে পেরেছে এ বছর। অন্যদিকে বছরের মাঝামাঝি এক মাসের মধ্যে তিন দফায় দেশের অর্ধেক জেলা বন্যাকবলিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। রোহিঙ্গা সংকট ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে।

চলতি বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও সব কিছু বন্ধ করার পথে যেতে হয়। ফলে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। কল্যাণব্রতী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি কাটাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে শিল্পঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এর আগেও বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এবারের মতো এত বড় আকারের প্রণোদনা প্যাকেজ এর আগে আর দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলে উঠতে সরকার যে প্যাকেজটি ঘোষণা করেছিল, সেটা মোটামুটি যথার্থ ছিল। সব খাতকেই কাভার করেছিল। প্যাকেজে অর্থের পরিমাণও বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতার তুলনায় বেশ ভালো ছিল। নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য যে ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটা বিতরণে হতাশাজনক অবস্থা সত্ত্বেও সরকার নতুন আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এর পরিমাণ হবে ১০ হাজার কোটি টাকা। এই প্যাকেজের আওতায় কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র (সিএমএসই) উদ্যোক্তাদের ঋণসুবিধা দেওয়া হবে।

কল্যাণমুখী সরকার করোনা মোকাবেলায় সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যেই দেশের প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধক ভ্যাকসিন বা টিকা পাবে। সবাইকে বিনা মূল্যে দুই ডোজ করে এই টিকা দেবে সরকার। প্রথম দফায় নতুন বছরে ভারত থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা আনার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে বাংলাদেশ। আর মে-জুনের মধ্যে কোভ্যাক্সের আওতায় আরো ছয় কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাবে। দেশে টিকা আসার পর কিভাবে, কাকে, কখন তা দেওয়া হবে বা কারা কখন কিভাবে পাবে—সেই পরিকল্পনা সরকার এর মধ্যেই প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে।

অনেক হতাশার মধ্যেও আশা জাগিয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বছরটি শুরু হয়েছিল নতুন রেকর্ড দিয়ে। ২০২০ সালের জানুয়ারির প্রথম ১৫ দিনেই প্রায় এক বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে বাংলাদেশে। ১ জানুয়ারি থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রবাসীরা ২০.৫০ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা ২০১৯ সালের পুরো সময়ের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। এর আগে এক বছরে বাংলাদেশে এত রেমিট্যান্স আর কখনো আসেনি। ২০১৯ সালে ১৮.৩৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বছরের শেষার্ধে এসে সাফল্যের নতুন মাইলফলক স্থাপিত হলো। দৃশ্যমান হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশের মানুষের জন্য পদ্মা সেতু নিছক একটি বড় সেতু নয়, সত্যিকার অর্থেই দুঃসাহসী এক স্বপ্ন। পরাক্রমশালী বিশ্বব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নিজেদের টাকায়ই আমরা পদ্মা সেতু গড়ব।’ স্বল্পন্নোত একটি দেশের জন্য বিদেশি কোনো সাহায্য ছাড়াই ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা খরচ করে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপই ছিল। নিজেদের অর্থায়নে সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী যে আত্মবিশ্বাসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার মূল অংশের বাস্তবায়ন হয়েছে ৪১টি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে। পদ্মা সেতুর পুরো ৬.১৫ কিলোমিটারই দৃশ্যমান হয়েছে। ইস্পাতের এই কাঠামোটি শুধু পদ্মার এপার-ওপারকে যুক্ত করেনি, এটা আমাদের এক ঐতিহাসিক অর্জন। আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আছে সরকারের।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। আস্থার এই ধারা আরো বেগবান হবে। দক্ষিণাঞ্চলের সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান। আর সেটা হলে এখন যে জলবায়ু চ্যালেঞ্জের শিকার অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে ঝুঁকিপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক কাজকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমে আসবে। দক্ষিণ বাংলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। মোংলা ও পায়রা বন্দরের কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে। ঢাকার কাছে বলে পদ্মার ওপারে ছোট-বড় নানা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদন-২০২০-এ বলা হয়েছে, করোনার সময়েও বিশ্বের মানব উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ এগিয়েছে ৬০ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। পরিবেশের প্রভাবজনিত সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচকে আরো ৯ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ আরো দুই ধাপ এগিয়েছে। বর্তমানে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। এ ছাড়া মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়েছে ১৪.৪ বছর।

আর এসব অর্জনের পেছনে যে মানুষটির নিরলস শ্রম ও অধ্যবসায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দীক্ষা কল্যাণমন্ত্রে, যে কারণে  উন্নয়নের ব্রত সাধনায় তিনি নিয়োজিত থাকেন সর্বক্ষণ। ‘পিপল ফার্স্ট’ দেশের মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা থেকে ধার করে বলি, ‘সঙ্কটের কল্পনাতে ম্রিয়মাণ’ হননি তিনি। মুক্ত করে ভয়, ‘আপনা মাঝে শক্তি’ ধরে, নিজেকে জয় করেছেন তিনি। ‘নিজেকে দীন নিঃসহায়’ মনে করেননি কখনো। নিজের ওপর ভর করতেও কোনো সংশয় ছিল না তাঁর। প্রাণপণ করেই ‘দুরূহ কাজে’ নিজের ‘কঠিন পরিচয়’ দিতে পেরেছেন বলেই বাংলাদেশ আজ সব সংকট মোকাবেলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা ২০২০-কে বিদায় জানাচ্ছি। ২০২১-কে স্বাগত জানাতেও আমরা সংকুচিত নই। রূপকল্প ২০২১—সে লক্ষ্যও অর্জিত হবে তাঁরই নেতৃত্বে, আমরা আশাবাদী।

লেখক: সাংবাদিক, ছড়াকার।

সূত্র: কালেরকণ্ঠ।

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –