• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ছয়দিনের সফরে ব্যাংককে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী গরমে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশ-ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কাতারের আমিরের সফরে যা পেল বাংলাদেশ

সুদ ছাড়াই মুক্তি মিলছে দারিদ্রতার, নারীরা হচ্ছেন স্ব-নির্ভর

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯  

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার দুই হাজার নারী। আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ’র মাধ্যমে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারা। এ প্রশিক্ষণে বদলে গেছে তাদের জীবনের আর্থিক দুঃস্বপ্ন। সুদ ছাড়াই বিশেষ কৌশলে মুক্তি মিলছে দারিদ্রতার। হচ্ছেন স্ব-নির্ভর। 

আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাটি প্রথমে নারী সদস্যদের হাতে-কলমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব নারীরাই দলের রেজুলেশন লেখা শিখেছেন। এছাড়া পাস বইয়ের মাধ্যমে সদস্যদের টাকা জমা দেয়া-নেয়া ও দলীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখা ও উত্তোলন সম্পর্কে জেনে কাজে লাগাচ্ছেন। তাছাড়া সদস্যদের মাঝে সুদবিহীন ঋণ প্রদানসহ সব দলীয় কার্যক্রম নিজেরাই পরিচালনা করতে পারছেন। অল্প-শিক্ষিত নারীরাই স্ব-নির্ভর দলের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ নিরসন ও যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছেন।

অল্প শিক্ষিত নারী সদস্যরা মুষ্ঠির চাল সংগ্রহ করেন। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল স্ব-নির্ভর দলগুলোর ফান্ডে জমা করা হয়। চাল সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি দলে রয়েছে একটি ড্রাম। কোনো সদস্যের ঘরে খাবারের চাল না থাকলে ফান্ডে রাখা চাল থেকে ধার দেয়া হয়। তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর তা ফেরত দিতে হয়। ফান্ডে নির্দিষ্ট পরিমমাণ চাল জমা রেখে অবশিষ্ট চাল বিক্রি করে সেই টাকা দলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রাখা হয়। এছাড়া সাপ্তাহিক প্রতি সদস্য ২০ থেকে ৫০ টাকা হারে সঞ্চয় জমা হয়। তাদের জমানো টাকা থেকে সুদবিহীন ঋণ নিয়ে সদস্যরা হাঁস-মুরগী ও ছাগল পালন, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন, চাষাবাদ করছেন। 

স্ব-নির্ভর দলের সদস্যরা সংস্থার দেয়া (অফেরতযোগ্য) পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা দলে রিভলভিং হিসেবে জমা করে আট হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত সুদবিহীন ঋণ গ্রহণ করে উৎপাদনশীল সম্পদ ক্রয় করছেন। এতে প্রতিটি পরিবারে দুই-তিন ধরনের উৎপাদনশীল সম্পদ বেড়েছে। এছাড়া বেড়েছে পরিবারের আয়ও।

ডিপপাড়া স্ব-নির্ভর দলের সভাপতি রঙ্গিলা বলেন, আমি অল্প শিক্ষিত হয়েও দলের নেতৃত্ব দেই। দলের কোনো সদস্যের সমস্যা দেখা দিলে তার পাশে দাঁড়াই। এরইমধ্যে সরকারি বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সদস্যসের মাঝে ভিজিডি কার্ড, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা করে দিতে সক্ষম হয়েছি। 

তিনি আরো বলেন, আগে আমি মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতাম। স্ব-নির্ভর দলের সদস্য হওয়ার পর কারো বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করি না। ‘ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ’ আমাদের অধিকার ও উন্নয়নের পথ দেখিয়েছে। পরিবারে ও সমাজের মাঝে মর্যাদার সঙ্গে বেচেঁ থাকার পথ দেখিয়েছে। আমি স্ব-নির্ভর দল করে এক লাখ টাকায় এক বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছি। এখন আমার চারটি গরু, একটি ছাগল ও ১০টি মুরগি রয়েছে। স্বামীকে কাঁচামাল ব্যবসার পুঁজি দিয়েছি। এখন বাড়িতে একটি গরুর খামার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি।

মাজেদা খাতুন বলেন, আমি দলের সাপ্তাহিক সভায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা সম্পর্কে জেনে ইউপিতে যোগাযোগ করে রেশন কার্ড পেয়েছি। ৪০ দিনের কর্মসূচির আওতায় কাজ করছি। দল থেকে সুদবিহীন টাকা ধার নিয়ে ল্যাট্রিন নির্মাণ করেছি। বিভিন্ন উৎপাদনশীল সম্পদ করেছি। এখন তিনটি গরু, দুটি ছাগল ও একটি দোকানের মালিক হয়েছি।

তিনি আরো বলেন, গবাদিপশু পালন ও দোকান নিজে পরিচালনা করি। এরইমধ্যে স্বামীকে একটি অটোভ্যান কিনে দিয়েছি। আমার উপার্জিত টাকা সংসারের উন্নয়নে ব্যবহারের ফলে পরিবারে গ্রহণযোগ্যাতা বেড়েছে। এছাড়া সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে। এ পথ দেখানোয় ইসলামিক রিলিফের কাছে চির কৃতজ্ঞ।

প্রকল্প সমন্বয়কারী মনির হোসেন বলেন, ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। ফোরাম সিড-সুইডেন’র আর্থিক সহায়তায় সংস্থাটি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের দুটি ইউপির (ডাঙ্গীপাড়া ও বকুয়া) দুই হাজার অতি-দরিদ্র ও দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে কাজ করছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধি ও জেন্ডার বৈষম্য কমাতে তিন বছর মেয়াদী ‘Promoting Women Empowerment Rights and Economic Development (POWERED)’ নামক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

২০১৭ সালের মার্চে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে প্রকল্পটি দুই হাজার পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে ৬৭টি স্ব-নির্ভর দল গঠন করেন। এরপর পরিবারের নারী সদস্যদের আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করে ”ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ”। প্রতি সদস্যকে অফেরতযোগ্য এককালীন পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা করে দেয়া হয়। ৬৭টি স্ব-নির্ভর দলের মুষ্ঠির চাল ও সাপ্তাহিক জমানো টাকায় (নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত) সঞ্চয়ের পরিমাণ ৪৭ লাখ ৫৩৭ টাকা। 

তিনি আরো বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে স্ব-নির্ভর দলগুলি ৩৩টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, ৩৫টি দাম্পত্য কলহ নিরসন ও আটটি যৌতুকবিহীন বিবাহ সম্পন্ন করেছে। এক হাজার ৯৫৮টি পরিবার স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন নির্মাণ ও এক হাজার ৮৩২টি পরিবার নিরাপদ পানির জন্য টিউবওয়েরের নিচ পাঁকা করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, অধিকার ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। নারীদের উৎপাদনশীল সম্পদও বেড়েছে। পরিবারে নারীদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। বেড়েছে আগের চেয়ে নারী স্ব-নির্ভরতা। তাছাড়া নারীর ক্ষমতায়নও বেড়েছে। 

উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জিয়াউল হাসান মুকুল বলেন, সংস্থাটির কার্যক্রম অত্যন্ত সুন্দর, যা অন্যান্য সংস্থার চেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী। হরিপুরবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ’র ভূমিকা প্রশংসনীয়। তারা গ্রামের দরিদ্র মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এতে নারীরা সরকারি দফতরের তাদের সেবা ও অধিকার আদায়সহ পারিবারিকভাবে আর্থিক উন্নতি লাভ করছে।

ইউএনও মো. আব্দুল করিম বলেন, ‘ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ’ প্রকল্পের প্রতিটি কার্যক্রম সরকারি সব দফতরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে অধিকার বাস্তবায়ন করছে। আমি স্ব-নির্ভর দল, সদস্যের বাড়ি পরিদর্শন করেছি। তাদের এ স্ব-নির্ভর কার্যক্রম খুব ভাল লেগেছে। হরিপুরসহ সারা বাংলাদেশে এ রকম প্রকল্প দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি। 

তিনি আরো বলেন, ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ’র পদ্ধতি অনুযায়ী সারাদেশে এমন প্রকল্প নেয়া হলে দেশের হত-দরিদ্র ও অসহায় পরিবারগুলো স্ব-নির্ভর পরিবার হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে।

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –